আজকের বিশ্বে ধর্মীয় সংলাপ, সমালোচনা এবং সংশয় ক্রমশ বাড়ছে। এর ফলে মুসলমানদেরকে প্রায়ই এমন কিছু কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যা ইসলামের মূল বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানে বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে সন্দেহ সৃষ্টি করে। এই লেখায় এমন ২০টি প্রশ্ন উপস্থাপন করা হলো, যেগুলো জানা একজন মুসলমানের জন্য প্রয়োজনীয়—শুধু আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নয়, বরং জ্ঞানের আলোকে, শিষ্টাচার ও প্রজ্ঞার সাথে উত্তর দেওয়ার জন্য।
১. যদি মহাবিশ্ব বিগ ব্যাং (Big Bang) দিয়ে শুরু হয়ে থাকে এবং সব কিছুই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহর প্রয়োজন কী?
এটা মূলত নাস্তিক এবং বিজ্ঞানমনস্কদের কাছ থেকে শোনা যায়। তারা বলে—কসমোলজি, পদার্থবিদ্যা ও জীববিজ্ঞান যখন সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিতে পারে, তখন একজন সৃষ্টিকর্তার দরকার কী?
২. হিন্দুধর্ম ৭,০০০ বছরের পুরোনো, কিন্তু ইসলাম মাত্র ১,৪০০ বছরের পুরোনো। তাহলে ইসলাম কীভাবে সর্বশেষ এবং পরিপূর্ণ ধর্ম হতে পারে?
অনেক হিন্দু মনে করেন যে প্রাচীন ধর্মই সত্য। তারা প্রশ্ন করেন—একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ধর্ম কীভাবে নিজেকে চূড়ান্ত ও সর্বশ্রেষ্ঠ দাবি করতে পারে?
৩. বিজ্ঞানে যখন প্রায় সব কিছুর ব্যাখ্যা আছে, তখন ধর্মে সময় নষ্ট কেন? নামাজ, কুরআন পড়া কি এখন অপ্রয়োজনীয়?
এই যুক্তি তুলে ধরে অনেকে বলেন—যেহেতু বিজ্ঞান দিয়ে সব কিছু বোঝা যায়, তাই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এখন অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক।
৪. ইসলাম মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ করে, অথচ কাবা একসময় মূর্তিতে পূর্ণ ছিল। এটা কি ইসলামের ইতিহাসে দ্বৈতনীতি নয়?
সমালোচকরা বলেন—ইসলামের আগেই কাবায় ৩৬০টি মূর্তি ছিল। তাহলে মুসলমানরা কেন এখনও সেই স্থাপনাকে পবিত্র মনে করে?
৫. কুরআনে বলা আছে: “মূর্তিপূজকদের যেখানে পাও হত্যা করো” — এটা কি সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহ দেয় না?
এই আয়াতটি প্রায়ই ভুলভাবে উদ্ধৃত হয়। সমালোচকরা দাবি করেন যে ইসলাম অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শেখায়। আসল ব্যাখ্যা না জানলে বিভ্রান্তি হয়।
৬. ইসলাম বলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” — অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই। এটা কি বিভাজনমূলক নয়?
এই বক্তব্য অনেকের কাছে অন্য ধর্মের অবমূল্যায়ন মনে হয়। তারা বলে—সব দেবতাকে মিথ্যা বলা ধর্মীয় সহনশীলতার পরিপন্থী।
৭. নবী মুহাম্মদ (সা.) অদৃশ্যের জ্ঞান জানতেন না, অথচ কুরআন বলে, ঈসা (আ.) গায়েব জানতেন। তাহলে কি ঈসা (আ.) শ্রেষ্ঠ?
কিছু খ্রিস্টান কুরআনেরই আয়াত দেখিয়ে দাবি করেন যে যেহেতু ঈসা (আ.) গায়েব জানতেন, তাই তিনি নবী মুহাম্মদের চেয়ে বড়।
৮. নবী (সা.) বলেছেন: “আমি জানি না কিয়ামতের দিন আমার কী হবে।” তাহলে উনি অন্যদের পথপ্রদর্শক কীভাবে?
এই বক্তব্য ব্যবহার করে সমালোচকরা বলেন—যিনি নিজের ভবিষ্যত জানেন না, তিনি অন্যদের গাইড করতে পারেন না।
৯. মুসলমানরা শুধু আরবিতে নামাজ পড়ে কেন? আল্লাহ কি সব ভাষা বোঝেন না?
অনেকে মনে করেন—যদি আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সবার রব হন, তবে যেকোনো ভাষায় নামাজ পড়া উচিত। তাহলে শুধু আরবি কেন?
১০. মুসলমানরা নিরীহ পশু কোরবানি করে কেন? আত্মত্যাগের জন্য কি ভালোবাসা, সেবা বা কষ্ট যথেষ্ট নয়?
পশু কোরবানি নিয়ে পশুপ্রেমী বা নাস্তিকরা বলে থাকেন—এটা নিষ্ঠুরতা এবং পুরনো রীতি। কেন মানুষ আত্মত্যাগের জন্য মানবিক কিছু করে না?
১১. নবী (সা.) আয়েশা (রা.)-কে অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন — এটা বর্তমান নৈতিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিভাবে?
এই প্রশ্ন প্রায়ই শিশু বিবাহ ও নৈতিকতার প্রসঙ্গে তোলা হয়। পশ্চিমা মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে সমালোচকরা এটিকে আপত্তিকর বলেন।
১২. ইসলাম যদি শান্তির ধর্ম হয়, তাহলে মুসলিম-প্রধান দেশগুলোতে এত যুদ্ধ ও সহিংসতা কেন?
এই প্রশ্নে ইসলাম ও রাজনীতিকে মিশিয়ে বলা হয়—যদি ইসলাম সত্যিই শান্তিপূর্ণ হয়, তাহলে মুসলিম দেশগুলো এত দ্বন্দ্বপূর্ণ কেন?
১৩. পুরুষ একাধিক স্ত্রী রাখতে পারে, কিন্তু নারীর জন্য সেই অধিকার নেই কেন?
নারী অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বড় প্রশ্ন। সমালোচকরা বলেন—এটা স্পষ্ট লিঙ্গবৈষম্য।
১৪. ইসলাম ধর্ম ত্যাগকারীকে (মুরতাদ) শাস্তি দেয় কেন? এটা কি ধর্মীয় স্বাধীনতার বিরোধিতা নয়?
আধুনিক মানবাধিকারে ধর্ম পরিবর্তনের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু ইসলামী শরিয়াতে মুরতাদদের শাস্তি থাকায় প্রশ্ন ওঠে—এটা কি জবরদস্তি নয়?
১৫. ইসলাম সমকামী সম্পর্ককে পাপ বলে কেন? এটা কি বৈষম্য নয়?
আজকের বিশ্বে LGBTQ+ অধিকার স্বীকৃত। ইসলাম যে সমকামিতাকে হারাম বলে, সেটিকে অনেকে বিদ্বেষমূলক বা অনৈতিক বলে।
১৬. একজন মেয়ে কেন পৈতৃক সম্পত্তিতে ছেলের অর্ধেক পায়?
সমালোচকরা বলেন—নারীকে কম দেওয়া মানে তার আর্থিক অধিকার হরণ। এটা কি সমতার পরিপন্থী নয়?
১৭. ইসলাম একমাত্র সঠিক ধর্ম দাবি করে — তাহলে অন্য ধর্মের সৎ মানুষদের কি কোনো মর্যাদা নেই?
এই প্রশ্ন ধর্মীয় বহুত্ববাদ নিয়ে। প্রশ্ন তোলা হয়—যদি ইসলামই একমাত্র সঠিক, তাহলে অন্যদের ন্যায়পরায়ণতা মূল্যহীন?
১৮. যদি সব কিছু আল্লাহর নির্ধারিত, তাহলে মানুষকে তার কাজে শাস্তি বা পুরস্কার কেন?
এটা একটা দর্শনগত প্রশ্ন। যদি সবকিছু আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে, তাহলে মানুষ নিজে দায়ী কীভাবে?
১৯. চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া, মেরাজ — এসব কি বিজ্ঞানের বিরোধী নয়?
যেসব অলৌকিক ঘটনা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়, সমালোচকরা সেগুলোকে কল্পকাহিনী বলে মনে করেন।
২০. শরিয়াহ আইন অনুযায়ী রজম (প্রস্তর নিক্ষেপ), অঙ্গচ্ছেদ — এসব কি বর্তমান যুগে অমানবিক নয়?
অনেকেই শরিয়াহর কিছু শাস্তিকে কঠোর, বর্বর এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে করেন। তারা বলেন—এগুলো আধুনিক মানবাধিকারের পরিপন্থী।